স্যুট-টাই —– ওয়াহিদুল আলম সোহেল
জীবনে কখনো পাঞ্জাবী পরেন নি এমন বাঙ্গালি পুরুষ পাওয়া ভার। কিন্তু কখনো স্যুট-টাই পরেন নি এমন পুরুষ অসংখ্য। অবশ্য এ দুইয়ের ভেতর পাঞ্জাবী হলো পুরুষের একান্ত পোষাক। কারণ পুরুষের প্রায় সব পোষাকই নারীরা পরিধান করেছে। অার অাছে লুঙ্গি। ওটাও পুরুষের একান্ত। বাকি সব, জিন্স, শার্ট, টি শার্ট এবং অামাদের অাজকের অালোচ্য পোষাক, স্যুট-টাইও, মেয়েরা তাদের পেশাগত প্রয়োজনে গায়ে জড়িয়েছে।
স্যুট-টাই সাধারণ পোষাক নয়। যে কেউ ওটা পরে রাস্তায় ঘুরতে পারে না। এটি সভ্য সমাজের পোষাক বলে এলিটগণ সারাক্ষণ পরে থাকেন। সভ্য এ পোষাকটি ব্যক্তির মধ্যে এক প্রকার শারীরিক ভারিক্কি ভাব অানয়ন করে। হয়তো সে কারণেই সভ্যগণ এটিকে নিত্যকার বসনে রূপ দিয়েছেন। সরকারি অামলাগণ, বিচারপতিগণ, বিজনেস পাইওনিয়ার, শীতাতপপ্রিয় বড় কর্মকর্তাগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ স্যুট-টাই পরে সভ্য সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন।
অপ্রয়োজনেও স্যুট-টাই অনেকের পরিধেয় বস্ত্র। ব্যাংক কিংবা বীমা কোম্পানির কর্তারা যে স্যুট-টাই পরেন তা যতটা না অফিসিয়াল কারণে তারচে’ বেশি গ্রাহক-দৃষ্টি অাকর্ষণ করবার প্রয়োজনে। একবার ব্যাংকের এক অল্প বয়েসি যুবক ক্যাশিয়ারকে দেখি টাকা গোনার সময় বারবার ডানহাত তুলে গলার টাইয়ের গিটটি নাড়ছে। যেন বা গিটটি ঠিক অাছে কিনা দেখে নেয়া। ভাবটি এমন যে, সে কাজটি দ্বারা বলতে চায়, দেখ অামি ব্যাংকে চাকুরি করছি বলে টাই পরেছি।
হ্যাঁ, টাইয়ের গিটটি একটি জানবার বিষয় বটে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল অামাদের জানাচ্ছেন এত বয়সেও তিনি এখনো টাইয়ের গিটটি পর্যন্ত জানেন না। অধ্যাপক হলেও তাঁকে অবশ্য কখনো স্যুট-টাই পরতে দেখিনি। “ইত্যাদি”র উপস্থাপক হানিফ সংকেতকে গত পনেরো বছরে কখনো স্যুট-টাই পরা ব্যতীত মঞ্চে দাঁড়াতে দেখিনি। এবং অামার এক প্রিয় মানুষ, অধ্যাপক অাবদুল্লাহ অাবু সায়ীদ সারাজীবন পাজামা-পাঞ্জাবী পরে কাটিয়ে দিলেন। স্যুট-টাই বোধকরি তাঁর কল্পনাতেও নেই।
খুব ছোটবেলায়, ঈদে, একবার শখ করে গলায় টাই পরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। টাই নয়, ওরকম লম্বা কিছু গলায় ঝোলানো। অামার এখনো মনে পড়ে, তা দেখে এক ভদ্রলোক অামাকে সকৌতুকে বলেছিলেন, গলার ওটা কি মুখের লালা পড়লে মোছার জন্যে? অামি জানতাম মুখের লালা পড়ার বয়স তখন অামার ছিল না। তবু শিশুদেরও থাকে অাত্মসম্মানবোধ। হয়তো সে কারণেই অপমানটি সহ্য করা অামার পক্ষে কঠিন ছিল। ঐ ঘটনার পর অদ্যাবধি অামি টাই পরিনি অার।
বড় হয়ে অামি জেনেছি স্যুট-টাই পরার একটা শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা লাগে। এলিট ক্লাসের না হলেও অন্তত গ্রাজুয়েশনের গণ্ডি পার হওয়া চাই। অাজকাল রাজনীতির ব্যানারেও দেখি ক্লাস এইটের গণ্ডি পার হতে না পারা তৃণমূলের কর্মিটিও স্যুট-টাই পরা ছবিতে তার নেতার ছবির পাশে অদ্ভূতরকমে হাসছে। স্যুট-টাই অবশ্য তাকে পরতে হয়নি। কাজটি ফটোগ্রাফার করেছে গলা কেটে তার মাথাটি বসিয়ে দিয়ে।
চাকুরির ইন্টারভিউয়ের জন্যে জীবন-বৃত্তান্ত নামক পরিহাসটির সাথে জমা দিতে ছবি তুলতে যখন স্টুডিওতে গেছি স্টুডিওঅলা বলেছে, গলা কেটে দেব? অামি বলেছি, গলা কেটে দেব মানে কি? সে বলেছে, স্যুট-টাই পরিয়ে দেব? অামি হেসে বলেছি, না।
অাভিজাত্যের প্রতীকস্বরূপ এ পোষাকটির অাসল মজা বোধকরি টাই-এ। নানান রঙের বাহারি টাই ব্যক্তির রুচিবোধের পরিচয়ও বহন করে বটে। এমন বিলাসপ্রিয় পুরুষও অাছেন যার অালমারিতে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক বাহারি রঙের টাই নারীর অলংকারের মতো জ্বলজ্বল করছে।
জীবনে একবার স্যুট-টাই পরতে চায় না এমন কেউ নেই। অামারও ইচ্ছে। বিলাসী এ পোষাকটি কিনতে অনেক টাকা লাগে। অাজকাল দেখি কেউ কেউ বিয়ের মঞ্চেও স্যুট-টাই পরে মুখে রোমাল দেয়। কনে অানতে যায়। অামার ধারণা, তারা জানে না যে, স্যুট-টাই সে অনেক পরতে পারবে কিন্তু বাহারি শেরওয়ানি-টুপি জীবনে একবারই পরবার সুযোগ পাবে।
অামার অঞ্চলে, চট্টগ্রামে, বিয়ের একাধিক অলিখিত রীতির ভেতর কোথাও কোথাও এও এক রীতি যে, কনেপক্ষ বরকে দামি স্যুট-টাই বানিয়ে দেবে। এবং কনে শ্বশুরালয় থেকে যখন প্রথমবার বাপের বাড়ি যাবে তখন বরটি ক’দিন পর বানিয়ে দেওয়া সেই স্যুট-টাই পরে কনেকে অাবার অানতে যাবে। অবশ্য কনের পরিবার অবস্থাসম্পন্ন হলেই এমনটি ঘটে।
যদি কপালে বিয়ে থাকে, যদি বউটি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের কন্যা হয়, যদি কনের পিতা অাপনাকে স্যুট-টাই বানিয়ে দেন, যদি সুশীল-সমাজ ব্যাপারটিকে যৌতুক বলে সাব্যস্ত না করেন, তবেই, কেবল তবেই সাধপ্রিয় সাধ্যহীন অাপনি, জীবনে কোন একদিন স্যুট-টাই গায়ে জড়ানোর বিরল-বিলাসী অানন্দ উপভোগ করতে পারবেন।